ঢাকা | বঙ্গাব্দ

হুমায়ূন আহমেদ এর সাহিত্যের নানা দিক : সৈয়দ ওয়ালী

হুমায়ূন একটি অতি রুগ্ণ ইন্ডাষ্ট্রির সাথে জড়িত হাজার হাজার মানুষকে ঝুঁকি নেবার অনুপ্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছে! এই দেশে তার মতো লেখক এ জীবনে আর দেখব বলে মনে হয় না। অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়কর জনপ্রিয়তার বিচারে বাংলাা কথা সাহিত্যের জগতে তিনি এক অতুল্য সম্রাট!
  • আপলোড তারিখঃ 20-11-2024 ইং |
  • নিউজটি দেখেছেনঃ 44380 জন
হুমায়ূন আহমেদ এর সাহিত্যের নানা দিক : সৈয়দ ওয়ালী - ছবি: সংগৃহীত
ad728

নিঃসন্দেহে বাংলা কথা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ গল্প সৃজনের এক অদ্বিতীয় জাদুকর।


গল্প সৃজন ও চরিত্র সৃষ্টিতে তার অসামান্য ক্ষমতা ও শক্তিমত্তা টের পাওয়ার সাধারণ একটি উপায় এই যে, তার সৃজিত যে কোনো গল্প ও সে সব গল্পকে ঘিরে গড়ে ওঠা চরিত্রগুলোর অভিনবত্ব; যা পড়া মাত্রই এক রহস্যময় কারণে পাঠকের ভালো লাগতে শুরু করে। পাঠক নিজ অজান্তেই সেসব গল্প ও চরিত্রগুলোর সাথে জড়িয়ে পড়ে; একাত্ম অনুভব করে।


হুমায়ূন আহমেদ গল্প সৃষ্টির অতুলনীয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন; যেন তিনি জন্মেই ছিলেন নিজস্ব ভুবনের অপূর্ব-অদ্ভুত কিছু গল্প এই পৃথিবীর মানুষকে শোনাবার জন্যে। যেন তিনি তার সব গল্প ও উপন্যাসগুলো উপস্থাপন করার মাঝ দিয়ে আমাদের ডেকে বলতে চেয়েছেন, 'শোনো দুঃখ দুর্দশা তো মানব জীবনে থাকবেই, তাই বলে কি আনন্দ উপভোগ করা যাবে না; শোনা ও বলা যাবে না, মনের ভেতর জন্ম হতে থাকা, লকলকিয়ে বেড়ে উঠতে থাকা গল্পগুলোর কথা, তার অপূর্ব-অদ্ভত চরিত্রগুলোর কথা।


রসিকতার ভেতর দিয়ে জীবনের গভীর ব্যথা বেদনা ও ব্যর্থতাকে চিহ্নিত করার ও ছুঁয়ে ফেলার অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী হুমায়ূন আহমেদ। তুচ্ছ ঘটনাকে বর্ণনার ভেতর দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে উপস্থাপন করার নিদারুণ ক্ষমতার অধিকারী হুমায়ূন আহমেদ। তার এমন তরল উপস্থাপনাকে সাহিত্যের বহু সিরিয়াস পাঠক ভুল অনুবাদ করেছে। মনে করেছে এই দিকটি লেখক হুমায়ূন আহমেদের দুর্বল দিক। আদতে এই দিকটি হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উজ্জ্বলতম দিক।


হুমায়ূন আহমেদ এর কোনো গল্প কিংবা উপন্যাস পড়া শুরু করলে আর থামা যায় না। চুম্বকের মতো পাঠককে টেনে রাখতে পারেন তিনি বিস্ময়করভাবে। এমন জাদুকরি ক্ষমতা বিশ্বের খুব কম লোখকেরই থাকে। এমন ক্ষমতা বাংলা কথা সাহিত্যে খুব বেশি লেখকের নেই।


 

হুমায়ূন কোনো এক বা একাধিক জটিল গল্প/ঘটনার চুড়ান্তে পৌঁছাবার আগে অত্যন্ত সহজ ভঙ্গি ও মেজাজে একটির পর একটি ছোট ছোট দৃশ্য বা পরিস্থাতি সৃষ্টি করতে থাকেন ঘটনা পরম্পরা বজায় রেখে।


হাসতে হাসতে গুলি করার মতো অভিজ্ঞ, নির্লিপ্ত ও দক্ষ খুনি ভাষাই যেন হুমায়ূনের গল্পের ভাষা। ভাষা বিষয়ক পণ্ডিতি দেখাবার প্রচলিত পথে না হেঁটে তিনি তার বিভিন্ন গল্প ও তার চরিত্রদের যেন এমন বৈচিত্রময় বৈশিষ্টপূর্ণ ভাষা সৃষ্টি করেছেন যার ধরণটি বিভিন্ন কিন্তু লক্ষ্য ভেদে (তা গল্প নির্মাণ কিংবা পাঠক চিত্ত জয় যাই হোক না কেন) অব্যর্থ। 


তিনি যে তার এমন বৈচিত্রময় গল্প ভাষার জন্য কী ব্যাপক মাত্রায় সফল তা তার বিশ্বব্যাপি বৈচিত্রময় পাঠক গোষ্ঠী ও সংখ্যার দিকে তাকালেই তর্কাতীতভাবেই প্রমাণিত হয়।


নভেলেট ‘১৯৭১’ 

ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পতিত হবার ভয়, ভয়ঙ্কর নির্যাতনের ভয়, আসন্ন মৃত্যুর ভয় কোনো সাধারণ মানুষকে যে কী ভীষণ এলোমেলো, নড়বড়ে করে দেয়, সমগ্র অস্তিত্বে কাঁপন ধরিয়ে দেয়, মানী কিন্তু দুর্বল চিত্তের মানুষের আচরণকে খেলো ও হাস্যকর করে দেয় নভেলেট '১৯৭১' এ তার কিছু নমুনা আছে। হুমায়ূন আহমেদের যেসব পাঠক এই নভেলেটটি পড়েন নি, তারা পড়তে পারেন।


বাংলাদেশের ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি ছোট্ট, দরিদ্র ও গণ্ডগ্রাম নীলগঞ্জ, সে গ্রামে বাস করা কয়েকটি পরিবার ও কিছু চরিত্র এবং দুই দল মিলিটারি ও তাদের নেতৃত্ব দেয়া এক মেজরের চিন্তা ও কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে যেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এদেশের সাধারণ মানুষের মর্মান্তিক জীবনের এবং পাকিস্তানি মিলিটারিদের নিষ্ঠুরতা ও ভয়ঙ্কর নির্যাতনের চিত্র (নাকি দলিল?) ফুটিয়ে তুলেছেন। 


দৃশ্য ও সংলাপ সৃজনে হুমায়ূন আহমেদ জাদুকর ছিলেন। যেমন তেমন জাদুকর নয়; অতি বিরল শ্রেনীর জাদুকর। এমন জাদুকর বাংলা সাহিত্য খুব বেশি দেখেনি, খুব বেশি পায়নি। তার সাহিত্যের নানা শ্রেনীর বিপুল সংখ্যক পাঠক যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

তার সৃজিত নভেলেট/উপন্যাসিকা '১৯৭১' যার একটি প্রমাণ।


গৌরীপুর জংশন

কবিগণ তাদের কবিতায় নানা উপমা দ্বারা যেমন সৃষ্টি করেন বহু ব্যঞ্জণ রসে পূর্ণ নানা বিশ্ব; হুমায়ূন আহমেদ তার গল্প ও উপন্যাসে কাহিনী বলার কৌশল, অদ্ভুত সব চরিত্র এবং সংলাপ দ্বারা সৃষ্টি করেন তেমনি নানা ব্যঞ্জণ রসে পূর্ণ এক ঘোর লাগা ও নান্দনিক বিশ্ব। 


যেহেতু বর্তমানে আমাদের হাতে খুব বেশি অবসর সময় থাকে না সুতরাং তার সব নভেলেট ও উপন্যাস পড়ার স্থলে বরং সেই বইগুলো পড়ুন যা তার গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি হিসাবে পরিচিত, যা আপনাকে আনন্দ দেবে ও ভাবাবে। 'গৌরীপুর জংশন' হুমায়ূনের তেমনি একটি নভেলেট বা উপন্যাসিকা।


এই বইটি একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করে উঠতে পারবেন বলে মনে হয় না। নভেলেটটি খুব বেশি বড়ও নয়, মাত্র ৫৫ পৃষ্ঠার। একটি রেল ষ্টেশন ও তাকে ঘিরে বেঁচে থাকা কিছু মানুষের জীবনযাপনের এক অপূর্ব ও ভিন্নধর্মী চালচিত্র এই 'গৌরীপুর জংশন'। 


১০

পোকা

'পোকা'র মতো উপন্যাস লেখার জন্য (বিভিন্ন ঘটনা/দৃশ্য এবং বিভিন্ন চরিত্রের জন্য উপযোগী) যে ভাষার প্রয়োজন, যে ভাষায় নিহিত থাকার দরকার ছিল, পরিমিতি, ঋজুতা, হিউমার, মৃদু কিন্তু তীক্ষ্ণ শ্লেষ, তেমনই এক যথার্থ ভাষা সৃষ্টির মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ তার 'পোকা' উপন্যাসটি সৃষ্টি করেছেন।


আর, যারা হুমায়ূন আহমেদ এর উপন্যাস পড়তে পছন্দ করেন কিন্তু এখনও 'পোকা' উপন্যাসটি পড়েন নি তারা অবশ্যই এই উপন্যাসটি পড়তে মিস করবেন না। 


১১

লীলাবতী : হুমায়ূন আহমেদ এর আরো এক মাষ্টারপিস

হুমায়ূন আহমেদ এর 'অচিনপুর' উপন্যাস এর ঘোর থেকে আজো আমি বের হতে পারিনি। লীলাবতী কি তেমনি আরো একটি ঘোর তৈরী করল? কে জানে...! মাত্রই পড়ে শেষ করলাম তো তাই বুঝতে পারছি না। 


তবে এইটকু বুঝতে পারছি তার রচিত নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, গৌরীপুর জংশন, পোকা, কে কথা কয়, মাতাল হাওয়া, মধ্যাহ্ন উপন্যাসগুলো যেমন আমার প্রিয় উপন্যাসের তালিকার অন্তর্ভুক্ত লীলাবতীও সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। 


লীলাবতী উপন্যাসটি যেন কোন উপন্যাস নয় বরং যেন এক অদ্ভুত বায়োস্কপ! যে বায়োস্কোপ দেখতে শুরু করার পর শেষটা না দেখা পর্যন্ত আপনি স্বস্তি পাবেন না এবং অন্য কিছুতে মনও বসাতে পারবেন না; যেন এই বায়োস্কোপের যে কোনো কিছু তা সে মানুষ, স্থান, প্রকৃতি ও ঘটনাসমূহ আমাদের পরিচিত হয়েও পুরোপুরি পরিচিত নয়...


১২

কে কথা কয়

হুমায়ূন আহমেদ জাদুকরই ছিলেন, নো ডাউট। উদ্ভট কিন্তু অবাস্তব নয় এমন সব চরিত্রে ঠাসা এই বইটিকে তারা সেরা রচনার তালিকায় রাখা না গেলেও ফেলে দেয়ার মত বইও এটি নয়। 

মতিন এর মতো নির্লোভী, দরদী, সাদাসিধা, জ্ঞানী ও মহৎ হৃদয়ের মানুষেরা অলখে ও নীরবে এই পৃথিবীতে বাস করে বলেই বেঁচে থাকা এখনও আনন্দের ও গৌরবের। সকলেই তো মুনার মতো, ফারুকের মতো বিশ্বাসঘাতক ও অকৃতজ্ঞ নয়। 


আমাদের চারপাশে কত যে ধূর্ত, কূটিল, ইতর, ধান্দাবাজ ও মানসিকভাবে অসুস্থ লোক বাস করে তারই এক চালচিত্র যেন এই বই। মুখোশের আড়ালে তাদের কুৎসিত ও ভয়ংকর রূপগুলো আমরা সর্বদা দেখতে পাই না বলেই হয়তো ঘুমাতে পারি নয়তো কী যে হতো আমাদের!


১৩  

মধ্যাহ্ন

যারা উপন্যাস পড়তে ভালবাসেন, যারা কথা সাহিত্যিক "হুমায়ূন আহমেদ' এর সাহিত্য ভালবাসেন তারা তাঁর অসাধারণ সৃষ্টি 'মধ্যাহ্ন' পড়ুন। 'মধ্যাহ্ন' আপনাকে নানা কারণে মুগ্ধ করবে। বিশেষ করে এই উপন্যাসের চরিত্রগুলো। কি জাদুকরী মুন্সিয়ানাতেই না এই জাদুকর এক বিশেষ ঐতিহাসিক সময়ের খোপে খোপে একেকটি চরিত্র সৃজন করেছেন। তাঁর সৃষ্ট উপন্যাসের মাঝে আমার যে অতি ছোট এবং প্রিয় একটি তালিকা আছে সেই তালিকায় উপন্যাস 'মধ্যাহ্নকে' জায়গা দিতে বাধ্য হলাম। 


১৪  

‘ফেরা’

মানুষকে ভালো না বাসতে পারলে মানুষের আনন্দ ও বেদনা অনুভব করা যায় না এবং সেসবের অংশীদারও হওয়া যায় না। আর অংশীদার হওয়া না গেলে মর্মস্পর্শী শিল্প সৃজন করা যায় কিনা আমি জানি না। হুমায়ূন আহমেদ এর ফেরা পড়তে পড়তে এমন প্রতিক্রিয়াই জন্মালো। কী দরদ দিয়েই না এক একটি চরিত্র সৃজন করেন তিনি! যে দরদ সব ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে। 


১৫

হুমায়ূন আহমেদ : এক সাহিত্যিক সম্রাটের নাম

হুমায়ূন আহমেদ এর মতো জনপ্রিয় লেখক আমি আমার জীবনে দেখি নি! যে দেশের লেখকেরা লেখালিখি করতে গিয়ে না খেয়ে মরতে বসে সেই দেশে একজন লেখক লিখেই রাজার মতো জীবন যাপন করেছে!


যুগের পর যুগ এই বই না পড়ুয়ার দেশে একুশে বইমেলার কয়েকটি স্টলে তার বই কেনার জন্য যে দীর্ঘ লাইন আমি দেখেছি তা ছিল অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়কর দৃশ্য! কোটি কোটি মানুষকে তিনি হাসিয়েছে এবং কাঁদিয়েছে, ভাবা যায়! 


হুমায়ূন একটি অতি রুগ্ণ ইন্ডাষ্ট্রির সাথে জড়িত হাজার হাজার মানুষকে ঝুঁকি নেবার অনুপ্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছে! এই দেশে তার মতো লেখক এ জীবনে আর দেখব বলে মনে হয় না। অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়কর জনপ্রিয়তার বিচারে বাংলাা কথা সাহিত্যের জগতে তিনি এক অতুল্য সম্রাট!