ডেস্ক রিপোর্ট: রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ ইস্যুতে অবস্থান পাল্টাবে না বিএনপি। সংবিধানের বাইরে না যাওয়ার যে দলীয় অবস্থান বিএনপির রয়েছে, সেটাতেই তারা বহাল থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বরং এই ইস্যুতে সাংবিধানিক শূন্যতা বা রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়, এমন কোনো উদ্যোগ না নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানাবে বিএনপি। পাশাপাশি দ্রুত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার কৌশলে থাকার পরামর্শ এসেছে। গত সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনা শেষে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্থায়ী কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও স্থায়ী কমিটির সদস্যরা অংশ নেন। বৈঠক সম্পর্কে স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে কাজ করা। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্যের দিকে নজর দেওয়া। একইসঙ্গে সাংবিধানিক কোনো শূন্যতা যাতে সৃষ্টি না হয়, সেদিকেও তাদের খেয়াল রাখা উচিত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপির কাছে কোনো মতামত চাওয়া হয়নি। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র নেতারা এসেছিল, তাদের সঙ্গে এক ধরনের কথা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে মতামত চাওয়া হলে, অবশ্যই বিএনপির সাড়া দেবে এবং আনুষ্ঠানিক মত জানাবে।
রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে ইতোমধ্যে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে বৈঠকে করেছেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র নেতারা। গত শনিবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, মো. সাহাবুদ্দিনের অপসরাণ ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন একমত পোষণ করেছে। দল দুটি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে তার অপসারণ চায়। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র ও জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে বিএনপির সঙ্গে কথা হয়েছে। বিএনপি দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাবে। এর প্রেক্ষিতে গত সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভাটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এই সভার প্রধান এজেন্ডাই ছিল রাষ্ট্রপতির অপসারণ ইস্যু। বৈঠকে থাকা একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সভার শুরুতে রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের আলোচনা তুলে ধরেন মির্জা ফখরুল। এরপর নেতারা তাদের অভিমত ব্যক্ত করেন। তারা ৫ আগস্টের গণঅভ্যূত্থান পরবর্তী রাষ্ট্রে নতুন করে কোনো ধরনের সংকট বা জটিলতায় পড়ুক- এমন পরিস্থিতি সতর্কভাবে এড়িয়ে চলার অবস্থান প্রকাশ করেন। বিশেষ করে, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ প্রশ্নে।
সভায় কেউ কেউ বলেন, সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির অপসারণ ও প্রক্লেমেশন অব সেকেন্ড রিপাবলিক (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের ঘোষণাপত্র) ঘোষণাসহ কয়েকটি দাবি তোলা হয়েছে। এ জন্য যদি সংবিধান বাতিল করা হয়, তাহলে দেশে বড় ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে। তারা যুক্তি তুলে ধরে বলেন, সাংবিধানিক সংকট এ জন্য সৃষ্টি হবে যে, রাষ্ট্রপতি কার কাছে পদত্যাগ করবেন- সে ধরনের কোনো অপশন খোলা নেই। প্রধান বিচারপতিও বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন বলে সভায় একজন জানান। সভায় নেতারা বলেন, বিপ্লব বা অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও সাংবিধানিক পথেই অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। সুতরাং সেই সংবিধানকে উপেক্ষা করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যৌক্তিক হবে না। দলটি মনে করছে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংবিধানকে বাতিল ঘোষণা করা হলে দেশে সাংবিধানিক সংকট বা রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি হবে। এমনটা হলে নির্বাচন আরও পিছিয়ে যেতে পারে বলে তাদের শঙ্কা।
স্থায়ী কমিটির সভায় বিএনপি নেতারা আরও বলেন, রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে দশটি কমিশন গঠন করেছে। তারাই মতামত দিবেন কী ধরনের সংস্কার হতে পারে। তাদেরকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া উচিত। বাইরে থেকে নানা ধরনের দাবি তুললে, কমিশন ঠিকমতো কাজটা করতে পারবে না। সভায় এবার ৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ জাঁকজমকভাবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ওইদিন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে বড় ধরনের শোডাউন করবে দলটি। দেশব্যাপীও বৃহৎ আকারে দিবসটি পালিত হবে। এ উপলক্ষে ঢাকাসহ সারাদেশে জেলা ও মহানগরে ১০ দিনের কর্মসূচি থাকবে। ৭ নভেম্বর কেন্দ্রিক কর্মসূচির পর অবস্থা বুঝে সাংগঠনিক কর্মসূচির গতি বাড়ানো-কমানো হবে। সভায় মতামত এসেছে, দ্রুততম সময়ে সরকারের উচিত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা এবং দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের দিকে নজর দেয়া। বিএনপি আগামী দিনে তাদের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক সব ধরনের কর্মসূচিতে দ্রুত নির্বাচনের ব্যাপারে সোচ্চার হবে। এর মধ্য দিয়ে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে দলটি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে রাষ্ট্রকাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কারে দশটি কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কয়েক দফা সংলাপও করে সরকার। এমন অবস্থায় শেখ হাসিনার পদত্যাগের দালিলিক প্রমাণ নেই বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। তার এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ কয়েকটি সংগঠন তার পদত্যাগের দাবি তোলে। গত ২২ অক্টোবর বঙ্গভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচিও পালন করে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২২ অক্টোবর রাতে বিএনপির সিনিয়র নেতারা ভার্চুয়ালি তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে নেতারা জানান, অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা ঠিক হবে না। এমনটা হলে দেশে সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হবে, নির্বাচন আরও দীর্ঘায়িত হবে। দলের এই সিদ্ধান্তের পরদিন ২৩ অক্টোবর যমুনায় গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেন জানান বিএনপির তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল। সেখানে বিএনপি নেতারা বলেন, তারা চান না, দেশে নতুন করে কোনো সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হউক। ওইদিন বিকেলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, রাষ্ট্রপতির পদটা একটা সাংবিধানিক পদ বা একটা প্রতিষ্ঠান- সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ। এই পদে হঠাৎ করে পদত্যাগের মাধ্যমে শূন্যতা সৃষ্টি হলে রাষ্ট্রীয় সংকট ও সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে। এটি হলে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথটা বিলম্বিত, বাধাগ্রস্ত কিংবা কন্টকাকীর্ণ হবে, যা জাতির কাম্য নয়। এরপর ওইদিন ২৩ অক্টোবর রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটি আবার বৈঠকে বসে। সেখানেও বলা হয়, গণঅভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর দেশের সংবিধান স্থগিত করা হয়নি। রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে এখন সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
বিএনপির এমন অবস্থানে রাষ্ট্রপতি অপসারণ ইস্যুতে ছাত্রনেতাদের দাবি কিছুটা থমকে যায়। এরপর এ ইস্যুতে ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী জানান, তারা সরকারের কাছে সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটা কাউন্সিল গঠনের পরামর্শ দেবেন। সেখানে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কে কোন প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতি হবেন, তা তারাই আলোচনা করে নির্ধারণ করবেন। রাষ্ট্রপতির অপসারণসহ পাঁচ দফা দাবি নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা গত ছয় দিনে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ ছয়টি দল ও তিনটি জোটের সঙ্গে আলোচনা করেন।