ডেস্ক রিপোর্ট: দিন দিন দুর্বিনীত হয়ে উঠছে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। আর এই পর্যায়ে তারা নিরাপদ ডেরা হিসেবে বেছে নিয়েছেন বন্দর নগরী চট্টগ্রামকে। তুলনামূলকভাবে অন্যান্য এলাকার চেয়ে এখানকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছাড় দেওয়ার মানসিকতা এবং রাজনৈতিক দল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের মধ্যে বিভক্তির জের ধরে চট্টগ্রামকেই নিষিদ্ধ সংগঠনের অপতৎপরতার উর্বর ভূমি হিসেবে বেছে নিয়েছে সংগঠনটির ক্যাডাররা।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ছাত্রলীগের কথিত সাংগঠনিক নেত্রী ও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে শুধু চট্টগ্রামেই ছোট-বড় অন্তত সাতটি মিছিল করেছে সংগঠনটি। নিয়মিত বিরতিতে সশস্ত্র মহড়া দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন দেয়ালে চিকা লিখে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানোর অপচেষ্টা করছে তারা। অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতিসহ ঢাকা ও চট্টগ্রামের শীর্ষনেতাদের অধিকাংশই ভারতে নিরাপদে অবস্থান করে বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
জুলাই বিপ্লবের পর ১৮ অক্টোবর প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে সশস্ত্র মিছিল করে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। রাত সাড়ে ১১টায় হঠাৎ করেই চট্টগ্রামের জামালখান এলাকায় সশস্ত্র মিছিল বের করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। এ সময় যানবাহন ভাঙচুরের চেষ্টাও করে তারা। কিন্তু সাধারণ মানুষ সংগঠিত হয়ে উঠলে পালিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। ২৭ অক্টোবর নিষিদ্ধ হয় ছাত্রলীগ।
পরে ১৭ নভেম্বর মধ্যরাতে নগরীর প্রবর্তক মোড়ে মিছিল বের করে। একই দিন জামালখান সড়ক ও খুলশীর জাকির হোসেন রোডেও ঝটিকা মিছিল বের করে একসময়ের ‘হেলমেট বাহিনী’ হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগ। একদিনের ব্যবধানে ১৮ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে খোদ সিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ের বিপরীতে বাগমনিরাম স্কুলের গলি থেকে ব্যানারসহ মিছিল বের করে ছাত্রলীগ। সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে সরকার ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক স্লোগানও দেন তারা। সিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ের সামনের এলাকাটি নগরীর খুলশি ও চকবাজার থানার অন্তর্গত। কিন্তু মিছিলের বিষয়টি অস্বীকার করে দায় এড়ায় দুই থানা।
সবশেষ গত বৃহস্পতিবার ভোরে সিএমপি কমিশনারের কার্যালয় থেকে কয়েকশ মিটার দূরে নগরীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট জিইসি মোড় এলাকায় ফের মিছিল বের করে নিষিদ্ধ সংগঠনটি। নেতৃত্বে ছিল চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি মিজানুর রহমান ও ইরফান উদ্দিন এবং মহানগর ছাত্রলীগের নেতা হাসনাত খান আতিফ। ১০ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা এলাকায় অবস্থান করলেও পুলিশের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।
মিছিলের চরিত্র:
ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর শুধু চট্টগ্রামের পাঁচটি মিছিলের মিছিলের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিটি হয়েছে গভীর অথবা ভোর রাতে। মিছিলের আগে দুটি নম্বরপ্লেটবিহীন মোটরসাইকেলে করে চারজন পুরো এলাকায় কয়েকটি চক্কর দিতে দেখা গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাষায় যা রেকি নামে পরিচিত।
অগ্রবর্তী টিমটি যখন রেকি করে তখন আশপাশের চায়ের দোকানগুলোতে অবস্থান করে ক্যাডাররা। সুযোগ বুঝে মুখে মাস্ক অথবা হেলমেট পরে নেয় তারা। এর পরপরই একজন বেরিয়ে স্লোগান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশ থেকে অন্যরাও যোগ দেয় মিছিলে। এ সময় শরীরে লুকিয়ে রাখা বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের প্রদর্শন রেকি করা ওই মোটরসাইকেল দুটি মিছিলের সামনে চলে আসে। ওই বাইক দুটির যাত্রী উল্টোভাবে বসে মোবাইলে ভিডিও করে ছড়িয়ে দেয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
চট্টগ্রামকে বেছে নেওয়ার কারণ:
সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, পতনের পর প্রথম মিছিল বের করা হয়েছে জামালখাল এলাকা থেকে। উগ্র ধর্মীয় সংগঠন ইসকনের শক্ত অবস্থান আছে এই এলাকায়। আওয়ামী লীগ আমলে ইসকন সদস্য সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের ঘাঁটি হিসেবেও পরিচিত ছিল এলাকাটি। এ ছাড়া যে কয়টি মিছিল বেরিয়েছে তার অধিকাংশই নওফেলের নির্বাচনি এলাকা। টানা ক্ষমতায় থাকার সুযোগে এসব এলাকায় বিভিন্ন সামাজিক ও পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে নওফেলের শক্ত অবস্থান আছে। ফলে মিছিল শেষে এসব প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় পাচ্ছেন নিষিদ্ধ সংগঠনের কর্মীরা। পড়ে বেশভূষা বদলে মিশে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে।
নগরীর জামালখান, চেরাগী পাহাড়, আন্দরকিল্লা, লালখানবাজার, জিইসি, গোলপাহাড়, প্রবর্তক, মুরাদপুর, ষোলশহর ও পাঁচলাইশ এলাকায় এমন বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা হয়েছে বলেও দাবি গোয়েন্দা সংস্থাটির।
ছাত্রলীগের ভয়ংকর রূপ:
গত ১৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে ছাত্রলীগের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, রাহাজানিসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে নগরবাসী পরিচিত হয়ে উঠলেও তাদের ভয়ংকর রূপ দেখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। ১৬ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত পুলিশি পাহারায় প্রকাশ্যে অন্তত ছয়জনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। এ ছাড়া অন্তত ৩০০ আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা ছাত্রলীগের নৃশংসতার শিকার হন।
২০ দিনের সহিংসতায় ষোলশহর দুই নম্বর গেট, মুরাদপুর, শুলকবহর, লালখান বাজার, বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও, নতুনব্রীজ, নিউমার্কেট ও লালদিঘি এলাকায় নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালানো ২২ জন অস্ত্রধারীকে চিহ্নিত করে নগর পুলিশ। যদিও অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের সংখ্যা ছিল আরো বেশি। ১৬ জুলাই মুরাদপুরে ৫ অস্ত্রধারীর মধ্যে ছিল ছাত্রলীগের সাবেক নেতা নুরুল আজিম রনি, যুবলীগের হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর, স্বেচ্ছাসেবক লীগের মোহাম্মদ দেলোয়ার, ছাত্রলীগের কর্মী এনএইচ মিঠু ও যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ ফিরোজ। ১৮ জুলাই চান্দগাঁও এলাকায় মহিউদ্দিন ফরহাদ, মোহাম্মদ জালাল ও মোহাম্মদ তৌহিদকে স্থানীয় বাসিন্দারা শনাক্ত করে। তবে আজ পর্যন্ত ধরা পড়েনি কেউ।
অনৈক্যের সুযোগে ফেরার স্বপ্ন:
৫ আগস্টের আগে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ফ্যাসিবাদ পতন আন্দোলনে একাট্টা হলেও পরে আর একমঞ্চে দেখা যায়নি কাউকে। আওয়ামী লীগ আমলে কোনো গ্রুপিং না থাকলেও সরকার পতনের পর বিভক্তি বেড়েছে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির ভেতর। আহ্বায়ক কমিটিতে এরশাদুল্লা ও নাজিমুর রহমানের অনুসারীরা বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নিলে কোণঠাসা হয়ে পড়েন সাবেক আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন ও আবুল হাসেম বকরের অনুসারীরা।
তবে আদালতের রায়ে ডা. শাহাদাত হোসেন সিটি মেয়র নির্বাচিত হলে সিটি করপোরেশন কেন্দ্রিক হয়ে পড়েন তার অনুসারীরা। গত ছয় মাসে বড় দুটি কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ছাড়া দুই পক্ষকে এক হতে দেখেননি নগরবাসী।
জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে শক্তিশালী অবস্থান জানান দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরাও তাদের ঐক্য ধরে রাখতে পারেনি। নানা কারণে কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন তরুণ নেতারা।
রাজনীতি বিশ্লেষক বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের মহাসচিব জিয়া হাবিব আহসান বলেন, এত রক্তের বিনিময়ে ফ্যাসিস্ট অপশক্তির পতন ঘটানো হলেও ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় নেতাদের নজিরবিহীন ঐক্যে ফাঁটল ধরেছে। তারা এখন নিজেরাই কাদা ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত। আর এই কারণেই পতিত শক্তি ফের ফিরে আসার স্বপ্ন দেখছে। একই সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সন্ত্রাসী ভূমিকাসহ গত ১৬ বছর ধরে দানবে পরিণত হওয়া শাসক দলের ছাত্রসংগঠনটির বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ না হওয়ায় এক রকমের ‘ওয়াক ওভার’ পেয়ে গেছে তারা। নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের অপ্রতিরোধ্য অপতৎপরতায় কয়েক মাসের মধ্যে হতাশ হতে শুরু করেছে সাধারণ মানুষ।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন বলেন, নিষিদ্ধ যে কোনো সংগঠনের সভা সমাবেশ করার অধিকার নেই। তাই ছাত্রলীগের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের বিপরীতে মামলা হওয়ার সুযোগ আছে। বিশেষ ক্ষমতা আইন ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে এসব মামলা রেকর্ড হওয়ার কথা। কিন্তু এসব অপতৎপরতার ব্যাপারে নতুন কোনো মামলা আজ পর্যন্ত হয়নি। লোক দেখাতে দু-একজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও তাদের চালান দেওয়া হচ্ছে পুরোনো মামলায়। ফলে কয়েক দিনের মধ্যে জামিনও পেয়ে যাচ্ছে তারা। সার্বিকভাবে ছাত্রলীগের এই অপতৎপরতার জন্য পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা দায়ী।
ছাত্রলীগের পদধারী নেতারা অনেকেই ভারতে:
চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ অপু ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নুরুল আজিম রনি। একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও চাঁদাবাজি সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বহিষ্কৃত হন রনি। এরপর যুগ্ম সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীরকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হলেও সংগঠনটির অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ থাকে রনির হাতেই। জুলাই বিপ্লবে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর কয়েক দিন আত্মগোপনে থাকলেও তারা সবাই এখন ভারতে।
সেখান থেকেই কখনো ভারতীয় সিম কার্ড ব্যবহার করে আবার কখনো হোয়াটস অ্যাপ কিংবা মেসেঞ্জারে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের রূপরেখা দিচ্ছেন তারা। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দম হোসেনসহ নিষিদ্ধ সংগঠনের শীর্ষনেতাদের বেশির ভাগই ভারতে অবস্থান করছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অবস্থান:
ছাত্রলীগের এই অপতৎপরতা বন্ধ, জুলাই গণহত্যায় জড়িতদের ফাঁসি ও ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচারের দাবিতে গত বৃহস্পতিবার অনশন কর্মসূচি পালন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাংশের নেতাকর্মীরা। পরে জেলা প্রশাসকের আশ্বাসে তিন দিনের আলটিমেটাম দিয়ে কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন তারা।
সংগঠনটির সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ বলেন, প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণেই সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ তাদের অপতৎপরতা চালানোর সুযোগ পাচ্ছে। জুলাই বিপ্লবে চিহ্নিত অস্ত্রধারীরা এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক জন দেশ ছেড়ে গেলেও পদে থাকা অসংখ্য নেতাকর্মী এখনো দেশের ভেতরেই গা ঢাকা দিয়ে আছে। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আর এই কারণেই অপতৎপরতার পাশাপাশি জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় নেতাকর্মীদের ওপর গুপ্ত হামলা চালানোর হুমকিও দিচ্ছে তারা।
প্রশাসনের বক্তব্য:
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ সংগঠন। তাদের ব্যাপারে পুলিশের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে হঠাৎ করে মিছিল বের করে জনসাধারণের মধ্যে ভীতি ছড়ানোর অপচেষ্টা করছে তারা। অনেক ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে না হলেও পরে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। হাসিব আজিজ বলেন, ৩০ জানুয়ারি ভোরে জিইসি মোড় এলাকার মিছিলে অংশ নেওয়া ১১ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের কয়েকজন এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে। বাকিদেরও গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া চলছে।