ঢাকা | বঙ্গাব্দ

জয়তু 'মা'

কাকন চাল, যার উৎপাদন দিনকে দিন কমে যাচ্ছে, ছিলো সকালের নাস্তা বা টি ব্রেকের অন্যতম উপাদেয় রেসিপি। আজকাল এটি দেখা যায় না বললেই হয়।
  • আপলোড তারিখঃ 23-11-2024 ইং |
  • নিউজটি দেখেছেনঃ 35328 জন
জয়তু 'মা' - ছবি: সংগৃহীত
ad728

আমাদের "জেনারেশন এক্স" ও "মিলেনিয়াল" যুগের মধ্যবিত্ত মায়েরা ছিলেন জাস্ট "সুপার উইম্যান"। বহু ছেলে-মেয়ে, নিকট আত্মীয় সমৃদ্ধ সংসার পরিচালনায় তারা ছিলেন দক্ষ "ম্যানেজার"। ঐ সকল সুপার উইম্যান মায়েদের কল্যাণে শত সমস্যা সত্বেও ঘরের অভিভাবক স্বামীর আর্থিক দৈন্যদশা কাটিয়ে মায়েদের বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্তগুলো বড় বড় সাংসারিক বিপর্যয় সামলে নিতে পারতো। বলাবাহুল্য তাদের নিকট তখন বর্তমান সময়ের মতো স্বয়ংক্রিয় উপকরণ কিংবা 'রেডি মিক্স' খাদ্য পণ্য/মশলা ছিলোনা। আর্থিক সংগতি ও প্রযুক্তির দুরাবস্থায় যা হাতে পেতো তা দিয়ে আলাদিনের দৈত্যের মতো 'কাস্টমাইজড্' রেসিপি বানিয়ে ফেলতো..!!


আমার মাও ছিলেন ঠিক তেমনি একজন "সুপার ওম্যান"। সংসারের অন্য দায়িত্বের কথা বাদ দিলাম, '৭০/'৮০ দশকের একজন টিপিক্যাল মা ও মাঝারি মানের এক সরকারি কর্মচারীর স্ত্রী হিসাবে পরিবারের রাজধানী নামক "রান্নাঘর" ও খাদ্য বিভাগ সামলানো প্রতিদিনকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে সূর্যোদয়ের মতোই তার সম্মুখে আবির্ভূত হতো। তাছাড়া পুরো আত্মীয় স্বজনের মধ্যে চট্টগ্রাম শহরে আমাদের পরিবারটির সরব অস্তিত্ব ছিলো বিধায় আত্বীয় স্বজনের বিশাল বহরের চাপ মায়ের উপর দিয়েই যেত....! 


সচরাচর ভাবে দিনের শুরুটা হতো রেশনের মতো বরাদ্দকৃত ৩ পিস রুটি (কপাল জোরে অন্য কারো থেকে সুসম্পর্কের ভিত্তিতে শেয়ারে অর্ধেক পিস জুটতো) বা মায়ের মতিগতি ভালো থাকলে কিংবা কোন কারণে বাসায় একটু ঘি বা ডালডা অবশিষ্ট থাকলে পরোটা, কয়েক টুকরা গুড় বা চিনি বা আগের দিনের পুরনো একটু তরকারি (অনেকে আবার হালকা বাসি বা চাটগাইয়া ভাষায় "আলাইয়া" তরকারি পছন্দ করতো) বা অর্ধেক বাটি ডাল সহযোগে নাস্তা দিয়ে । কেউ কেউ একটি রুটি বাঁচিয়ে তা ঐ সময়ের বহুল প্রচলিত জ্বালানি কাঠ বা ভুষির চুলার আগুনে স্যাকে হালকা পোড়া মচমচে করে আজকালকার "ক্রিসপি" চিপসের মতো কুরকুরে আওয়াজ নিয়ে খেতো। আমি অবশ্য টেস্ট ভেরিয়েশনের জন্য মাঝে মাঝে রুটির উপর পাউডার দুধ আর চিনি মিশিয়ে অথবা আলু ভাজি , কখনোবা এক টুকরা মুরগির মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে অথবা ভাজা ডিম পেঁচিয়ে রোল করে খেতাম । তখন কি জানতাম এগুলোই আধুনিককালে শর্মা, টেকোস, টরটিলা বা স্প্রিং রোল হিসেবে পরিচিত পেতো.... !! অনেক সময় স্বাদে আরো বৈচিত্র আনার জন্য রুটির খামিতে অল্প একটু চিনি পানি মিশিয়ে দেয়া হতো।


রুটি জাতীয় খাদ্য বানানোর উপকরণ না থাকলে চালের "খুদ" (ভেঙ্গে যাওয়া বা অর্ধ গুড়া চাল) দিয়ে এক এক জনকে এক এক প্লেট (সচরাচর ভাবে রঙ্গিন ফুলে চিত্রায়িত টিনের বাসণ) "জাও" বা "জৌ" ভাত সাথে একটু গুড় বা চিৎ মিঠাই (নরম গুড়) বা রাফ (সিদ্ধ ঘনীভূত খেজুর রস) পরিবেশিত হতো। 


মাঝেমধ্যে বিন্নি চাল (মাঝেমধ্যে নারিকেল মেশানো) সাথে চিনি বা গুড় বা ঝাল তরকারি, নাস্তা হিসেবে তৈরি করা হতো। আবার কালেভদ্রে গেঁজানো (চিটাগাং এর স্থানীয় ভাষায় জ্বালা চাল) চাল পাওয়া গেলে তা গুঁড়া করিয়ে নারিকেল, চিনি ও শেষে পর্যাপ্ত দুধ দিয়ে বিশেষ সুস্বাদু রেসিপি "মধুভাত" তৈরি করা হতো। আর মধুভাত উপলক্ষে পাওয়া সকালকে ঈদ ঈদ মনে হতো। সাধারণত মধুভাত তৈরীর জটিল প্রক্রিয়ার কারণে একবারেই অনেক পরিমাণে বানানো হতো, যা ২/৩ দিন যাবত সকাল, বিকাল ও রাতে নাস্তা হিসেবে খাওয়া যেতো।


মধ্যাহ্নের আগে অথবা বিকেলের '"টি ব্রেকে" (তখন তো আর খাওয়ার সেশনকে এই নামে অভিহিত করা হতো না) মা পুরনো করকরে ভাতে হলুদ, কাঁচা মরিচ ও পর্যাপ্ত পেঁয়াজ মিশিয়ে দ্রুততম সময়ে "ভাত ভাঁজা" রেসিপি বানিয়ে দিতো। আর্থিক সংগতি কিংবা মায়ের মন মেজাজ ভালো থাকলে কয়েকটি ডিম সাথে হালকা ঘি মিশানো হতো। আর আধুনিক কালে এটিই কিনা অতি জনপ্রিয় "ফ্রাইড রাইস"...!


কাকন চাল, যার উৎপাদন দিনকে দিন কমে যাচ্ছে, ছিলো সকালের নাস্তা বা টি ব্রেকের অন্যতম উপাদেয় রেসিপি। আজকাল এটি দেখা যায় না বললেই হয়।


কোন কারনে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিলে, অনেকের ঘরে ভাতের "মাড়" সাথে হালকা লবণ মিশিয়ে বাটিতে পরিবেশন করা হতো। শুনেছি আজকাল এটি কোন কোন জায়গায় সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর স্যুপ হিসেবে পরিবেশিত হয়।


হাতের কাছে তৎক্ষণাৎ নাস্তা বানানোর কিছু না থাকলে মা বলতো, যা, জমি থেকে কয়েকটা লাল আলু তুলে নিয়ে আয়। ব্যাস, সেই আলু হয় গরম পানিতে সিদ্ধ নয়তো আগুনে পুড়ে গ্রিলড্ পটেটো স্টেক হয়ে যেত। 


সাধারণত "পান্তা ভাত" অনেকের নিকট সকালে নাস্তার জনপ্রিয় একটি রেসিপি ছিলো। এক্ষেত্রে আগের রাতে মা ছোট পাত্রে চাহিদা পরিমাণে ভাতের সাথে পানি মিশিয়ে রাখতো। সকালে পানি মেশানো ভাতের সাথে পুরনো তরকারি বা আলুর ভর্তা বা পেঁয়াজের চাটনি অথবা সংকট চললে শুধুমাত্র কাঁচামরিচ ও গোটা পেঁয়াজ সহযোগে তৈরি মজাদার নাস্তা ছিলো এটি।


সকালে বা দিনের অন্য সময়ের টি ব্রেকে দ্রুত মজাদার নাস্তা তৈরি করার প্রয়োজন হলে, মা এক বাটি আটার সাথে কয়েকটি ডিম মিশিয়ে বড়-ছোট বিভিন্ন সাইজের তেল পিঠা বানিয়ে দিতো। অনেক সময় সকালের বেঁচে যাওয়া রুটি অথবা ঝটপট নতুন কয়েকটি রুটি বানিয়ে তিনকোনা পিস করে কেটে দ্রুত তেলে ছেড়ে দিতো আর তার উপর চিনি ছিটকে দিতো। ব্যাস, মজাদার কুরকুরে ক্রিসপি একটি তেলের পিঠা তৈরি হয়ে যেতো, যা অনেকটা মেক্সিকান রেসিপি "নাচোস" এর মতই.…...!!


কোন কারনে টি ব্রেকে মায়ের তৈরি নাস্তা না পেলে আমি মাঝেমধ্যে চা বানানোর মগে চিনি মিশ্রিত দুধ নিয়ে তাতে অল্প পরিমাণে ভাত বা মুড়ি মিশাতাম, আর চামচ দিয়ে খেতাম। আবার মাঝে মাঝে চাতে রুটি বা "ঐতিহাসিক বেলা বিস্কিট" টুকরো বা ছিড়ে ছিড়ে মিশাতাম, আর একইভাবে চামচ দিয়ে খেতাম। তখন এটিকে আমার অমৃত মনে হতো।


মায়ের আরেকটি রেপিড আইটেম রেসিপি ছিলো। অনেক সময় একটি বা দুটি ডিম ভেঙ্গে তাতে হালকা সুজি অথবা আটা ও চিনি গুলিয়ে পিঠার মত ভেজে দিতেন। আহ্.....এখনো মনে হয় সেই স্বাদ জিভে লেগে আছে।


বাসায় মেহমান বা বিশেষ লোকজন থাকলে মা পিঠার ব্যবস্থা করতো। শীতকাল হলে ভাপা পিঠা আর অন্য সময়ে আতিক্কা পিঠা, জ্বালা পিঠা, ছাইন্না পিঠা (গুড় ও নারিকেল সহ), পাকন পিঠা, তাল পিঠা, চিতই পিঠা ইত্যাদি তৈরি হতো। তিনি কিভাবে যেন বিশেষ বিশেষ সময়ে এই রেসিপি গুলোর প্রস্তুতি নিয়ে রাখতেন। গৃহকর্তার পকেট গড়ের মাঠ হলে সমস্যা কি, মায়েদের রিজার্ভ ব্যাংক শাড়ির আঁচলের ঐ পেঁচানো গিটটুকু আছে না....!!


এভাবেই যে পরিকল্পনা নিয়ে সে যুগের মধ্যবিত্ত মায়েরা একান্নবর্তী পরিবারের সুপার ক্রিটিক্যাল "ফুড ম্যানেজমেন্ট" সেক্টর পরিচালনা করতেন, বর্তমান জমানার গৃহবধূ তো দুর কি বাত, একজন দক্ষ পেইড "ম্যানেজার " কিংবা "মাস্টার শেফ"ও পারবে কিনা সন্দেহ...!!

জয়তু "মা" 


লেখক: ওয়াহিদ আজাদ



notebook

চট্টগ্রামে আলোচিত হানিফ হত্যা মামলার প্রধান আসামি গ্রেফতার